পুরোনো মুখদেরই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দায়িত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি, বছরের পর বছর ধরে একই কমিটি এবং আঞ্চলিকতার প্রবল প্রভাবে নেতৃত্ব বিকাশে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। অথচ একসময় এ সংগঠনটির ওপর ভর করেই সারা দেশে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই সংগঠন পরিচিতি লাভ করেছিল। তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে সময়ের ব্যবধানে এখন আর সেই দিন নেই ছাত্রদলের। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায় ধীরে ধীরে মিইয়ে গেছে ছাত্রদলের দাপটও। সক্রিয় কার্যক্রম দূরের কথা, দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই কমিটি। জেলা-উপজেলাভিত্তিক কমিটি থাকলেও বেশিরভাগই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। সেইসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মারমুখী অবস্থানে সারা দেশে ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়েছে ছাত্রদল। নতুন শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি একেবারেই সীমিত হয়ে পড়ায় সংগঠনটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সাবেক ও বর্তমান নেতার অনেকেই উদ্বিগ্ন।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সারা দেশে ছাত্রদলের জেলার মর্যাদাসম্পন্ন শাখার সংখ্যা ১১৮টি। এর প্রায় অর্ধেক কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। ছয় থেকে আট বছর ধরে কমিটি ছাড়াই চলছে কোনো কোনো ইউনিট। নামকাওয়াস্তে কমিটি থাকলেও ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে ছাত্রদল। সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হলেও প্রবল হয়ে উঠেছে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং। নেতাদের মধ্যে চলছে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। এসব কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সংগঠনটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারছে না। যদিও এমন পরিস্থিতির জন্য ছাত্রদল নেতারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অসহিষ্ণু আচরণকে দায়ী করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান কেন্দ্রীয়ভাবে নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। কেবল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কয়েকজন সহসভাপতি এবং যুগ্ম সম্পাদক তাদের অনুগত নেতাকর্মীদের নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন। ২৮ অক্টোবরের পর কোনো কর্মসূচিতে দেখা মেলেনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের। এ অবস্থায় ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। অনেকেই পদপদবির আশায় বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন।
ছাত্রদলের সাবেক একাধিক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, ছাত্রদল হচ্ছে বিএনপির প্রবেশদ্বার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার পর এই সংগঠনের নেতারা বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে যোগ দেবেন। যার মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে এবং তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে আগ্রহী হবে। বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তিও ছাত্রদল। এই সংগঠনের নেতৃত্বেই নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাফল্য পেয়েছিল বিএনপি। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় ছাত্রদল সর্বস্তরে ব্যাপক আলোচনায় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ছাত্রদলের সেই গৌরব অনেকটাই ম্লান হয়েছে। ঐতিহ্য হারাতে বসেছে সংগঠনটি।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচ নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে ৩০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট শ্রাবণকে সরিয়ে রাশেদ ইকবাল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকলেও ঝিমিয়ে পড়েছে ছাত্রদল। ভারপ্রাপ্ত সভাপতিসহ কয়েক নেতাকে মাঝে মধ্যে বিক্ষোভ মিছিলে দেখা গেলেও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল প্রকাশ্য কর্মসূচিতে নেই।
জানা গেছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ছাত্রদলের আগামীর নেতৃত্ব নির্ধারণে তৎপর হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। মূল নেতৃত্বের জন্য সম্ভাব্য তালিকা যাচাই-বাছাই চলছে।অনেক ইউনিটে কমিটি নেই ৬-৮ বছর:ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সোহেল রানা ও আব্দুর রহিম সৈকতের নেতৃত্বে জাবি শাখার কমিটি দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। সেই থেকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি নেই।
কক্সবাজার জেলায় ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি হয়েছিল। এরই মধ্যে মেয়াদ শেষ হলেও ওই কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। একই অবস্থা ময়মনসিংহ উত্তর-দক্ষিণ, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলাসহ আরও কয়েকটি শাখার।রাজশাহী জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক এসএম সালাউদ্দিন আহমেদ শামীম সরকার জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের ১৯ সদস্যের কমিটি হয়েছে। তারা চলমান আন্দোলনে সকল কর্মসূচিসহ জেলায় সংঘবদ্ধভাবে কর্মসূচি পালন করছেন।
জানা গেছে, জেলার মর্যাদাসম্পন্ন ১১৮টি শাখার মধ্যে সাংগঠনিক শাখার মধ্যে গত এক বছরে প্রায় ৩০টির কমিটি হালনাগাদ হয়েছে। ঘোষণার অপেক্ষায় আছে আরও ১০-১৫টির। সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক কমিটির মেয়াদ নেই।
ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতিটি ইউনিটের নেতাকর্মীরাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। আন্দোলনের কারণেই কমিটি গঠন কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ যেসব শাখা মেয়াদোত্তীর্ণ, সেগুলোতে কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে।’কাজ নেই অধিকাংশ ইউনিটের, ঢাবিতে স্থবির:
জানা গেছে, নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে দল ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে বিএনপি। বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে দেওয়া সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, দিনাজপুর, নওগাঁ, কক্সবাজার, রাজশাহী, ফেনী, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, খুলনা মহানগরসহ কয়েকটি জেলায় আন্দোলন কর্মসূচিতে ছাত্রদল তুলনামূলক ভালো ভূমিকা রেখেছে। তবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও পশ্চিম, বরিশাল জেলা ও মহানগর, কুমিল্লা জেলা ও মহানগর, মুন্সীগঞ্জ ও রংপুর জেলায় ছাত্রদলের তৎপরতা নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা হতাশ।
এদিকে ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কার্যক্রম নেই। সংগঠনের বিগত কমিটির নেতারা ঢাবিতে সহাবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বর্তমান (শ্রাবণ-জুয়েল) কমিটি।
২০২২ সালের ২৪ মের পর থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি ছাত্রদল। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাবি ছাত্রদলের নতুন কমিটি (সোহেল-আরিফ) কমিটি ঘোষণা করা হয়। তারা ঢাবিতে কর্মসূচি পালনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সফল হননি; বরং কয়েকবার ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়েছেন।
ঢাবি থেকে বিতাড়িত হওয়ার নেপথ্যে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক জুয়েলের ভূমিকাকে দায়ী করেন সংগঠনের নেতারা। যদিও জুয়েল বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান বলেন, প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং ছাত্রলীগের অসহিষ্ণু আচরণের কারণে তারা ঢাবি ক্যাম্পাসে যেতে পারছেন না।
শীর্ষ পদের আলোচনায় যারা:
জানা গেছে, এবার নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ‘অবিবাহিত’ থাকার শর্ত শিথিল করার চিন্তা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। কারণ অতীতে এই শর্তের কারণে যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক নেতা ছাত্রদল থেকে ছিটকে পড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদে থাকতে চান বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, প্রথম সহসভাপতি তানজিল হাসান, রিয়াদ ইকবাল, সিনিয়র যুগ্ম সাধারন সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া। এ ছাড়া ২০০৭-২০০৮ সেশন থেকে আলোচনায় আছেন নাছির উদ্দীন নাছির, মাহবুব মিয়া, নিজাম উদ্দিন রিপন, আক্তারুজ্জামান আক্তার, আক্তার হোসেন, জহির রায়হান, ইব্রাহিম খলিল ফিরোজ, শাকির আহমেদ, মারুফ এলাহি রনি, আনোয়ার পারভেজ, ২০০৮-২০০৯ সেশনের মনজুরুল আলম রিয়াদ, সোহেল রানা, খোরশেদ আলম সোহেল, এইচএম আবু জাফর, এবিএম ইজাজুল কবির রুয়েল, শাফি ইসলাম, মো. রিয়াদ রহমান, হাসান আল আরিফ, শাহাজান শাওন, জিহাদুল ইসলাম রঞ্জু, কাজী জিয়া উদ্দিন বাসিত (জবি), ২০০৯-২০১০ সেশনের ঢাবির সাবেক সদস্য সচিব আমান উল্লাহ আমান, সালেহ মো. আদনান, ফারুক আহম্মেদ, শরিফ প্রধান শুভ, মোস্তাফিজুর রহমান, মমিনুল ইসলাম জিসান, হাসানুর রহমান, মাসুদুর রহমান মাসুদ এবং জসিম উদ্দিন