খুলনা জেলা পরিষদ সদস্যদের দোকান ভাগ বাঁটোয়ারা

লিটন কুমার রায় প্রকাশিত: ৪ জুলাই , ২০২৪ ১২:৩৮ আপডেট: ৪ জুলাই , ২০২৪ ১২:৩৮ পিএম
খুলনা জেলা পরিষদ সদস্যদের দোকান ভাগ বাঁটোয়ারা
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিধিমালা ভঙ্গ করে ওই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জেলা পরিষদের সদস্য ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের নামেও। খুলনার চুকনগরে জমি বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন অনিয়মের খেলায় মেতে উঠেছে খুলনা জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, খুলনার চুকনগরে ৫৬ শতক জমির ওপর স্বাধীনতার আগে নির্মিত হয় ডাকবাংলো। সেখানে ২০২০ সালে সেলামিমূল্যে ‘চুকনগর সুপার মার্কেট’ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে জেলা পরিষদ।

সরকারি জমিতে নেওয়া হয়েছিল বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্রকল্প। অনিয়মের কারণে তা বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। এখন সেই জমি ইজারার মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হলেও অভিযোগ রয়েছে, এই বরাদ্দের সময় হয়েছে ভয়াবহ রকমের দুর্নীতি।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিধিমালা ভঙ্গ করে ওই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জেলা পরিষদের সদস্য ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের নামেও। খুলনার চুকনগরে জমি বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন অনিয়মের খেলায় মেতে উঠেছে খুলনা জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, খুলনার চুকনগরে ৫৬ শতক জমির ওপর স্বাধীনতার আগে নির্মিত হয় ডাকবাংলো। সেখানে ২০২০ সালে সেলামিমূল্যে ‘চুকনগর সুপার মার্কেট’ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে জেলা পরিষদ।

তবে তাতে অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটি বাতিল করে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। এখন সেই জমিতে নতুন করে প্রকল্প নিয়েছে খুলনা জেলা পরিষদ। গত ১৯ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় ওই জমি ইজারা দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। পরে গত ৭ মার্চ খুলনা জেলা পরিষদ ষষ্ঠ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে ৮৮ জনের নামে এই জায়গা একসনা (এক বছরের) ইজারা দেওয়া হয়।

এই জমি ইজারা দেওয়াতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ছিল জেলা পরিষদ ইজারা বিধিমালা-২০১৭ অনুসরণ করার। তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, বাস্তবে সে নির্দেশ মানা হয়নি। এই বিধিমালার ৭(জ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘পরিষদের কোনো সম্পত্তি উহার চেয়ারম্যান, সদস্য বা কর্মচারীর নামে বা বেনামে বা তাহার কোনো আত্মীয়ের নামে ইজারা বা ভাড়া প্রদান করা যাইবে না।’ তবে তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত তালিকায় দেখা গেছে, এই জমি বরাদ্দ পেয়েছেন জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সরোজিত কুমার রায়, ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জি এম আব্দুল্লাহ, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রবিউল ইসলাম গাজী, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এমডিএ হালিম বাবু, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাবিনা ইয়াসমিন, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিলীপ হালদার, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এমডি মফিজ উদ্দীন, সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নাহার আক্তার, ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাসনা হেনা ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফারহানা নাজনীন।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জমি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও অনিয়ম হয়েছে কিনা তা বলতে অপারগ খুলনা জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘এটা আমার কাছে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। যারা যারা ইজারা পেয়েছেন, তারা পরিষদের সিদ্ধান্তে পেয়েছেন। আইনে কি আছে তা জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’ তবে পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য ফারহানা নাজনীনের কাছে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। একইভাবে পরিষদের অন্য সদস্যরাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।

এ ছাড়া ইজারা পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় দেখা গেছে একই ব্যক্তি দুটি করেও দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন। তারা হলেন- ইন্দ্রজিৎ দেব, কবিতা আঢ্য, জয়দেব আঢ্য, শেখ মো. আলাউদ্দিন, নিত্য গোপাল সিকদার, রূপা রানী সিকদার, তামীম হাসান, মো. আতিকুজ্জামান, জুঁই সাহা ও জ্যোৎস্না সিকদার। তালিকায় তাদের নাম দুইবার করে আছে। স্থানীয় দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই স্থানের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই জমিতে দোকান ঘর বানিয়ে বেশি টাকায় ভাড়া দেওয়া সম্ভব। যদিও জমি ইজারা নেওয়া হচ্ছে সামান্য মূল্যে।

ইজারা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, জমি বরাদ্দের জন্য ইজারাদারকে জেলা পরিষদের নির্ধারিত হারে ইজারামূল্য ও বিধি অনযায়ী আয়কর ও ভ্যাট দিতে হবে। সবচেয়ে ছোট আয়তনের ১০৬ বর্গফুটের দোকানঘরের আয়কর ও ভ্যাটসহ বার্ষিক ইজারা মূল্য ৭ হাজার ৬৩২ টাকা। আর সবচেয়ে বড় ১৪২ বর্গফুট আয়তনের দোকানঘরের আয়কর ও ভ্যাটসহ ইজারামূল্য ১০ হাজার ২২৪ টাকা। এখানেই অনিয়মের শেষ নয়। বিজ্ঞপ্তির শর্ত ভঙ্গ করে ওই জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা স্থাপনাও। যদিও ইজারা শর্তে রয়েছে, লিজপ্রদত্ত জমিতে কোনো স্থায়ী বা পাকা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। তবে লিজগ্রহীতা জেলা পরিষদের অনুমতি নিয়ে সেমিপাকা দোকানঘর বানিয়ে ব্যবসা চালাতে পারবেন। সম্প্রতি ওই স্থান পরিদর্শন করেছেন প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে ১২৬টি পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। অধিকাংশ ঘরে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে। স্থানীয় আটলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হেলাল উদ্দীন বলেন, যাদের নামে ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তারা অধিকাংশ এই এলাকার মানুষ না। স্থানীয়দের বঞ্চিত করে জেলা পরিষদের সদস্য ও তাদের আত্মীয়দের মাঝে এসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এখন এই জমিতে তারা প্রভাব খাটিয়ে ছাদযুক্ত পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছেন। ইজারা প্রদানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় আটলিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান প্রতাপ কুমার রায়। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলে করে দোকানঘর ইজারা দেখানো হয়েছে। প্রভাবশালীরা ছাদযুক্ত মার্কেট বানিয়ে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে। বাস্তবে ৯০ শতাংশ দোকানঘর আমাদের স্থানীয় মানুষকে দেওয়া হয়নি।

এসব অনিয়ম নিয়ে জানতে চাইলে খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজা রশীদ বলেন, এসব অভিযোগ স্থানীয়রা আমাদের কাছে দিয়েছেন। আমরা এর পরিপ্রেক্ষিতে সার্ভেয়ারকে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে বলেছি। তাতে যেসব অনিয়ম পরিলিক্ষিত হয়, তা জেলা পরিষদের সভায় উত্থাপন করা হবে।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo