যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীদের অনেকেই বলছেন, টিকটকে তাঁরা ট্রলের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন। এসব ট্রলের কারণে তাঁদের জীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিবিসির তদন্তেও এমনটা জানা গেছে।
শুধু কি ট্রল, রীতিমতো নিপীড়নের শিকার ও হুমকি পাচ্ছেন ভুক্তভোগী নারীরা। ফ্রান্সেও ঘটছে এমন ঘটনা। অনেক নারী যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। এ পরিস্থিতিতে অনেক নারী বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের ট্রলিং, নিপীড়ন, হুমকির কারণে তাঁরা খুবই হতাশ। তাঁদের অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কেননা, এসব বন্ধে কেউ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি কেঁদেছি। কিছু খেতে পারিনি। আমার ঘুম হতো না। মনে হয়েছিল, আমি এখানে আর থাকতে চাই না।’
যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারে বসবাস করেন সুলতানা (ছদ্মনাম)। নারীবিদ্বেষ ও তিক্ত হয়ে ওঠা সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তিনি টিকটককে বেছে নিয়েছিলেন।
সুলতানা জানান, ২০২১ সালে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হয়েছিলেন। ট্রলের শিকার হওয়া এক বন্ধুর হয়ে কথা বলার পর তাঁকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়।
তখনকার স্মৃতি হাতড়ে সুলতানা বলেন, ‘আমি কাজ করছিলাম। টিকটকে আমার কয়েকজন অনুসারী বার্তা পাঠান। জিজ্ঞেস করেন, আমাকে ট্রল করে প্রকাশ করা ভিডিওগুলো আমি দেখেছি কি না?’
সুলতানা আরও বলেন, ‘মানুষজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল পোস্টগুলোয় আমাকে নিয়ে নানা মন্তব্য করছিল। হাসাহাসি করছিল।’
এই ট্রল একপর্যায়ে রীতিমতো নিপীড়নে পরিণত হয়। বছর দুয়েক চলেছিল। সুলতানা বলেন, ‘আমি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লড়াই করেছি। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে থেরাপি নিয়েছি। ট্রলের ঘটনাগুলো আমার অসুস্থতা বাড়িয়ে দিয়েছে।’
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে টিকটক বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ইস্যুতে কথা বলেন। তবে ভুক্তভোগীদের অনেকে বলছেন, নারীরা অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলবেন, এটা নিজ সম্প্রদায়ের অনেকেই মানতে পারেন না। তাই তাঁদের থামিয়ে দিতে চান।
সুলতানাসহ ভুক্তভোগী আরও কয়েকজন নারী বিবিসিকে জানান, এই ট্রলের পেছনে জড়িত আছেন হাসান সায়েদ নামের বাংলাদেশি এক ব্যক্তি। হাসান ফ্রান্সের প্যারিসের শহরতলিতে থাকেন। টিকটকে হাসানের হাজার হাজার অনুসারী রয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেন হাসান। পরে সেসব ট্রল ভিডিওর ‘গ্রিন স্ক্রিনে’ জুড়ে দেন। এরপর হাসান টিকটকে লাইভে আসেন। ভুক্তভোগী নারীদের নিয়ে মজা করেন। এমনকি ধর্ষণ ও হত্যার হুমকিও দেন।
বিবিসির পক্ষ থেকে ই-মেইল পাঠিয়ে ও কল করে একাধিকবার হাসান সায়েদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সাড়া দেননি তিনি।
ভুক্তভোগীদের আরেকজন মাসুমা। থাকেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে। চাকরির পাশাপাশি রান্নার নানা সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। এ জন্য টিকটকে লাইভ করেন।
মাসুমা বলেন, ‘একদিন লাইভে ছিলাম। হাসান সায়েদ লাইভে যুক্ত হন। তাঁকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব দেন। প্রত্যাখ্যান করলে আমাকে “ঝুলিয়ে দেওয়ার” হুমকি দেন।’
এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টিকটিকে শেয়ার করেন মাসুমা। অনুসারীদের প্রতি ওই ব্যক্তির নামে রিপোর্ট করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। উল্টো ট্রলের শিকার হতে হয়েছে এই নারীকে।
মাসুমা বলেন, ‘ওই ব্যক্তি আমাকে নিয়ে ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। ভিডিওতে আমাকে “যৌনকর্মী” হিসেবে উল্লেখ করেছে।’
পরে টিকটকে মাসুমার অনুসারীরা ভিডিওটি নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট করেন। ভিডিওটি নামিয়ে ফেলা হয়। মাসুমা বলেন, ‘কিন্তু তত দিনে আমার যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।’
এ ঘটনার জেরে মাসুমা অনেক ‘অসংগত ফোনকল’ পেয়েছেন। অনেকে তাঁর সম্পর্কে বিব্রতকর প্রশ্ন করেছে, খোঁজখবর নিয়েছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মাসুমা। তিনি বলেন, ‘পুলিশের কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারাটা আমাকে আরও হতাশ করেছিল।’
তবে নিপীড়নমূলক ট্রলিংয়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম সরব হয়েছিলেন কামরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। যুক্তরাজ্যের স্ট্যাফোর্ডশায়ারে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি।
কামরুল বিবিসিকে বলেন, ‘শুরুতে ভেবেছিলাম, এসব ট্রল ভিডিও হয়তো ভুয়া। কিন্তু পরে বন্ধুদের কাছে জানতে পারি, হাসান সায়েদ বহু বছর ধরে যুক্তরাজ্যপ্রাবাসীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আসছেন।’
‘অনেকেই মনে করেন, যেহেতু টিকটকে হাসান সায়েদের হাজার হাজার অনুসারী আছেন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব হবে না’—এমনটাই বলেন কামরুল।
কামরুল আরও বলেন, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি সম্প্রদায় বেশ রক্ষণশীল। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের ভিডিওগুলো ভুক্তভোগীদের পরিবারের জন্য বেশ লজ্জার ও ভয়ের। তাই আমি এর বিরুদ্ধে কিছু করতে চেয়েছি। এসব বন্ধ করতে চেয়েছি।’
হাসানের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করেন কামরুল। মানুষকে ট্রল করে ভিডিও প্রকাশ করা বন্ধ করতে বলেন। ফল হয় উল্টো। তাৎক্ষণিকভাবে কামরুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ট্রল করেন হাসান।
কামরুল বলেন, ‘আমাকে নিয়ে ভিডিও বানানো শুরু করেন হাসান। তিনি আমার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ঢুঁ দেন। সেখান থেকে আমার এক বছর বয়সী ছেলে, আমার মা ও স্ত্রীর ছবি সংগ্রহ করেন। আমার মা ও স্ত্রীকে ধর্ষণের প্রকাশ্য হুমকি দেন।’
ওই সময় কামরুলের স্ত্রী রুকথান সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বাধ্য হয়ে কামরুল দ্বিতীয় সন্তানের অপেক্ষায় থাকা স্ত্রীকে সব খুলে বলেন। পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই সঙ্গে টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু টিকটক কর্তৃপক্ষ কামরুলকে জানিয়ে দেয়, এসব ভিডিওতে প্রতিষ্ঠানটির সম্প্রদায়গত দিকনির্দেশনা (কমিউনিটি গাইডলাইন) লঙ্ঘন করা হয়নি। পুলিশও তাঁকে আশার কথা শোনাতে পারেনি।
বাধ্য হয়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্যারিসে যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন কামরুল। নিজের সমস্যার কথা খুলে বলেন। সহায়তা চান তিনি। ওই সময় ইংরেজি ভাষা জানা ফরাসি আইনজীবী ম্যাথিউ ক্রোইজেতের সঙ্গে কামরুলের যোগাযোগ করিয়ে দেয় দূতাবাস।
পরে হাসানের নামে প্যারিসের সরকারি কৌঁসুলির দপ্তরে অভিযোগ আনেন ম্যাথিউ। অভিযোগে বলা হয়, ফরাসি আইন লঙ্ঘন করে এমন অন্তত তিনটি অপরাধ করেছেন হাসান। এর মধ্যে সহিংস হুমকি দেওয়া, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া এবং শিশু পর্নোগ্রাফি ও সাইবার বুলিং রয়েছে।
তবে মামলাটি কোন অবস্থায় আছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না কামরুল। আইনজীবী ম্যাথিউ বলেছেন, মামলার চূড়ান্ত পরিণতি পেতে অনেক সময় লেগে যাবে।
ম্যাথিউ বিবিসিকে বলেন, ‘ফ্রান্সে ইসলামভীতি প্রবল। কামরুলের নামের শেষে ইসলাম শব্দটি যুক্ত আছে। তাই মামলা আটকে যেতে পারে।’
মামলার হালনাগাদ জানতে প্যারিসের সংশ্লিষ্ট পুলিশ স্টেশন ও আদালতে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি। কিছুই জানানো হয়নি।
আইনি লড়াই চলা অবস্থায়ও কামরুল ও তাঁর পরিবার নিয়ে ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটকে একের পর এক ট্রল ভিডিও প্রকাশ করেছেন হাসান। এসব ভিডিও নামিয়ে নিতে বললেও সাড়া দেননি হাসান।
২০২৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যের তথ্য কমিশনারের দপ্তরে যোগাযোগ করেন কামরুল। ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে কামরুলকে বলা হয়, এসব কনটেন্ট বেশ উদ্বেগজনক। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত করেন তথ্য কমিশনার।
শিশুদের ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের বিষয়টি সামনে এনে টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে সাত দিনের মধ্যে এসব ভিডিও সরিয়ে নিতে বলে তথ্য কমিশনারের দপ্তর।
তিনটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জানায়, তাদের কমিউনিটি গাইডলাইনের সঙ্গে যায় না এমন সব ভিডিও, কনটেন্ট মুছে ফেলা হবে। ব্লক করা হবে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট।
কামরুল বিবিসিকে বলেন, তিনি প্রায় প্রতিদিন টিকটকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। হাসান যেসব নতুন অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিও প্রকাশ করছেন, সেসব বন্ধ করতে বলছেন। কিন্তু ভুক্তভোগী কামরুলের অভিযোগ, সব সময় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।(সূত্র:প্রথম আলো)