ধামইরহাটের মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরের ইতিহাস

মোঃ মোজাহারুল ইসলাম প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর , ২০২৩ ১০:০৪ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর , ২০২৩ ১০:০৪ এএম
ধামইরহাটের মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরের ইতিহাস
শহরের প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে দেরি হবে তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাত সাড়ে এগারোটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের কাজ শুরু করে দিল। শুরু হলো পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ, এই হত্যাযজ্ঞের যেন কোনো সাক্ষী না থাকে সেজন্যে সকল বিদেশী সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক ও শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ বর্বর হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটি নতুন নাম বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার জন্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ তারিখটা বেছে নিয়েছিল কারণ সে বিশ্বাস করত এটা তার জন্যে একটি শুভদিন। দুই বছর আগে এই দিনে সে আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমাতা পেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধাবেলা পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে দিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে বলেছিল, ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা কর তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে! গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা আছে সেই নীল নকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট, সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে কেমন করে আলাপ আলোচনার ভান করে কালক্ষেপণ করা হবে, কীভাবে বাঙালি সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করা হবে, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করা হবে, সোজা কথায়, কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

শহরের প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে দেরি হবে তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাত সাড়ে এগারোটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের কাজ শুরু করে দিল। শুরু হলো পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ, এই হত্যাযজ্ঞের যেন কোনো সাক্ষী না থাকে সেজন্যে সকল বিদেশী সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তারপরেও সাইমন ড্রিং নামে একজন অত্যন্ত দুঃসাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা শহরে লুকিয়ে এই ভয়াবহ গণহত্যার খবর ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন।

তারই ধারাবাহিকতায় নওগাঁর ধামইরহাটে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পিস কমিটির সদস্য ওসমান হাজির নির্দেশে ১৪ জন গৃহস্থ ও শ্রমিক গণহত্যার শিকার হন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে সহযোগিতা করার অপরাধে ২০ জন মুক্তিকামী জনতাকে কুলফৎপুর গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের পশ্চিম পার্শে পুকুর পাড়ে এসএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ১৪ জন নিরিহ গ্রামবাসিকে হত্যা করা হয়। এতে ঘটনাস্থলে ১৪ জন শহীদ হন এবং ছয় জন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। এদের মধ্যে অনেকেই মাঠে হাল চাষের সময় ও নিজ বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় পাক হানাদার বাহিনীর আটক করে।

বরেন্দ্রভূমির ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ক গবেষক ও লেখক প্রভাষক মো. আব্দুর রাজজাক (রাজু) স্যার বলেন, ধামইরহাট উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরব উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা সাপ্তাহিক "মুক্তিবার্তা" দ্বিতীয় বর্ষ ১১ তম সংখ্যায় ৬ জানুয়ারি ১৯৯৯ সন ৬ পৌষ ১৪০৫ বুধবার প্রকাশিত জরিপের পর গেজেটে ধামইরহাটের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়।

এছাড়াও অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক গণও মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। অনেকে পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্সের ভূমিকা পালন করেন। 

পাগলাদেওয়ান বধ্যভূমি :
ধামইরহাটের সবচেয়ে বড় বদ্ধভূমি পাগলাদেওয়ান বধ্যভূমি। বর্তমান মাদ্রাসা ও পীরের মাজার সংলগ্ন বধ্যভূমিটিতে বহু মুক্তিযুদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। হানাদার বাহিনীর বড় ঘাঁটি ছিল এটি।প্রতক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যমতে এখানে শতাধিক মানুষকে গর্তে পুঁতে হত্যা করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে আনা ৬ জন অজ্ঞাত সুন্দরী যুবতীকে দীর্ঘদিন বাংকারে আটকে রাখা হয়। পরে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলে যুদ্ধদশা থেকে মুক্তি পায়।

কুলফৎপুর গনকবর:
ধামইরহাটের কুলফৎপুরে ১৯৭১ সালে ১৪ই আগস্ট বাংলা ৩০ শে শ্রাবণ ওমার ইউনিয়নের কুলফৎপুর গ্রামের হাইস্কুলের পশ্চিম পার্শে পুকুর পাড়ে এসএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ১৪ জন নিরিহ গ্রামবাসিকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে  এক জন জনাব মো. আব্দুল মান্নান জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন।
শহিদরা হলেন (১) মো. তজুমদ্দিন মন্ডল, (২)মো. বিজু মদ্দিন মন্ডল, (৩) মো. আব্বাস আলী, (৪) মো. রহিম উদ্দিন, (৫) মফয়জুল ইসলাম, (৬) মো. আফতাব উদ্দিন, (৭) মো. আইজুদ্দিন, (৮) মো. সয়েফ উদ্দিন, (৯) মো. কসিম উদ্দিন,(১০)মো. আমজাদ হোসেন, (১১) মো. চানমদ্দিন, (১২)মো. আবীর উদ্দিন, (১৩) মো. মতিবুল হোসেন, (১৪) মো. আবেদ আলী মন্ডল। এই ১৪ জন শহীদের গণকবর একিস্থানে  দেওয়া হয়। (সূত্রঃ উদ্ভাস প্রথম সংখ্যা) 

হলাকান্দ গ্রমের বধ্যভূমি:
হলাকান্দর গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মোহাম্মদ আয়নাল ও তারেক জানান রাজাকার আল বদরদের চাপের মুখে আগ্রাদ্বিগুণ মাহমুদপুর, পাইকবান্দা, হলাকান্দর সহ বিভিন্ন এলাকার ৩৬ জন নিরিহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে তাদের লাশ পুঁতে রাখে।এর মধ্যে ১৮ জন তাদের এলাকার পরিচিত ছিল তারা হলেন (১)বুদু হেমরম, (২) সুকল হেমরম, (৩) সরকার মর্ম, (৪) টুন্ড টুডু, (৫) মাতলা টুডু, (৬) বান্টি সরেন, (৭) বধু রায় টুডু, (৮)সুরকা টুডু, (৯)সকল মরমু,(১০) মুশাই মুর্মু, (১১)রবিদাস বর্মন,(১২) যদু মর্ম,(১৩) ভুতু সরেন, (১৪)মুসি টুডু,(১৫) জোনা টুডু, (১৬)মাঝি সরেন, (১৭)বয়লা হাঁসদা,(১৮) খায়া সরেন। সহ মোট ৩৬ জনকে একসাথে গণকবর দেওয়া হয়। 
(মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ ও লেখচিত্রে নওগাঁ ১৯৮৭) 

ফার্সিপাড়া বধ্যভূমি:
ফার্শিপাড়া মাঠে একই স্থানে কয়েকটি গনকবর রয়েছে একটি উক্ত গ্রামের সহিদ ওসমান গণি তিনি অধ্যাপক  ওবায়দুল হক মিন্টুর পিতা ছিলেন। পার্শে মোহাম্মদ জমির উদ্দিন খোকার কবর রয়েছে।অপর পার্শে আরেকটি কবর পাঁচবিবির মাহতাস মঞ্জিলের মাহবুব আলী চৌধুরী ও আফাজ উদ্দিনকে সমাহিত করা হয়েছে।ফার্শিপাড়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে অনেকের গণকবর রয়েছে। 
(রাজশাহী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরের দিনগুলি)।

আগ্রাদিগুণ গণকবর:
অগ্রপুরি বিহার বা পরিত্যক্ত আগ্রাদ্বিগুন ঢিবিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের এর  কবর সহ অনেকের গনকবর রয়েছে।

‌‌‌‌‌বৈদ্যবাটি বধ্যভূমি :
বৈদ্যবাটি পাথরকুচি ঢিবি ও ধুরইল অঞ্চলে প্রায় ৪০ জন শিক্ষানবিশ মুক্তিযোদ্ধা ভারতের পারিলা ক্যাম্পের ট্রেনিং নিয়ে নওগাঁয় ফিরে আসার সময় এক বাড়িতে আশ্রয় নিলে প্রতিবেশীর বিশ্বাস ঘাতকতাই পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী রাতের অন্ধকারে বিলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে তাদের নির্মম ভাবে হত্যাকরে। তাদের বাড়ি ছিলো  আত্রাই রাণীনগর। তারাছিলো ট্রেনিংকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যাদেরকে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে হত্যা করেন। (স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাতে উত্তর রণাঙ্গনে নওগাঁর ভূমিকা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৯১ সংখ্যা) 

বরেন্দ্রভূমির পুস্পিত জনপদ আমাদের এই ধামইরহাট
অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের গর্বের ফসল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমাদের মুক্তিযুদ্ধারা। তাইত আমরা গর্বিত।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo