পটুয়াখালী-১ (সদর, দুমকি ও মির্জাগঞ্জ) আসনে ৩টি উপজেলা, ১টি পৌরসভা ও ২৫টি ইউনিয়ন। এ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও জাতীয় পার্টির হেভিওয়েট প্রার্থী দলের কো-চেয়ারম্যান সাবেক মহাসচিব ও মন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের চিন্তা ভাবনা বেড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা পটুয়াখালীকে আওয়ামী লীগের অধ্যুষিত এলাকা দাবী করে তারা অন্য দলের প্রার্থীকে মেনে না নেয়ার হুঁশিয়ারিও দেন।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন নাকি জাতীয় পার্টির এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার তাদের মধ্যে কে হচ্ছেন ৫ বছরের জন্য পটুয়াখালী-১ আসনের কান্ডারি তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনায় মূখরিত। উভয় দলের নেতাকর্মীরা দলের হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন জাপা মহাসচিব বর্তমান কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার নৌকার কাঁধে ভর করে পটুয়াখালী-১ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। একাদ্বশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে নেন সদ্য প্রয়াত ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া। সদ্য সমাপ্ত উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় এমপি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
এদিকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে একই আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে মাঠে আসছেন জাপা কো-চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। এ দু’জনের মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকেই পটুয়াখালী-১ আসনের নির্বাচনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। ভোটের মাঠে নতুন মেরুকরণের শুরু হয়। নির্বাচনের মাঠে জাতীয় পার্টিকে ধরে রাখতে আওয়ামী লীগ নিতে পারে ভিন্ন কোনো কৌশল। এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা ও হিসাব-নিকাশ। জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের এ ভিন্ন কৌশলকে পুরো মাত্রায় কাজে লাগাতে চায়। অন্যদিকে জেলা সদরের গুরুত্বপূর্ণ এ আসনটিকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিতে নারাজ। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেতা কর্মীরা চান তাদের দলের প্রার্থী। এজন্যই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনকে নিয়ে আগেই তারা মাঠে নেমেছেন।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চান নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে। ৩০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় মনোনয়ন বঞ্চিত তেমন কাউকে তার সঙ্গে দেখা যায়নি। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত বেশিরভাগ নেতাদের সঙ্গে জাপা প্রার্থী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার নিবির যোগাযোগ রাখছেন। জানা গেছে, তিনি কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার মনোনয়নপত্র দাখিলের পর পরই মনোনয়ন বঞ্চিত অ্যাডভোকেট তারিকুজ্জামান মনির’র (সদ্য প্রয়াত সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর পুত্র) বাস ভবনে ও আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন বঞ্চিত সাবেক পৌর ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মৃধা’র বাসভবনে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এছাড়া আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জাপার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে জাপা প্রার্থীর এ সিরিজ শুভেচ্ছা বিনিময় আগামী নির্বাচনের ভিন্ন কৌশল হিসেবে দেখছেন সাধারণ ভোটাররা। এ ব্যাপারে জাপার কো-চেয়ারম্যান সাবেক মহাসচিব ও মন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন’র সাথে এক সময় আমার ভালো যোগাযোগ ছিল।
এখন তিনি পটুয়াখালী-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করতে চান। তাই আগের মতো এখন আর তেমন যোগাযোগ হয় না।এসময় বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের অন্য সবার সঙ্গেই আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এ শেষ বয়সে নির্বাচন করলে আমি পটুয়াখালী-১ আসন থেকেই করব। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জোটের গুরুত্বসহ কয়েকটি বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্তই নিবেন।পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে ১টি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে নির্বাচনী এলাকা। আওয়ামী লীগের খারাপ-ভালো সময়ে এ আসন থেকে আ স ম ফিরোজ ৭ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এবার নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কঠিন প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন তিনি। দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ঢাকার শিল্পপতি হাসিবুল আলম তালুকদার।
তবে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কোনো প্রকার পাত্তা দিতে নারাজ আ স ম ফিরোজ। সব মনোনয়ন বঞ্চিতরা একাট্টা হয়ে ভোটের মাঠে তাকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন এটাকে তিনি কিছুই মনে করেন না। উল্টো তিনি বলেন, এটি একটি দুষ্টচক্রের আখড়া। যার কোনো প্রভাব সাধারণ ভোটারদের মাঝে পড়বে না বলে তিনি নিশ্চিত করেন।পটুয়াখালী-৩ আসন (গলাচিপা ও দশমিনা) ১টি পৌরসভা ও ১৯টি ইউনিয়ন নিয়ে নির্বাচনী এলাকা গঠিত। ’৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে প্রত্যেক নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। ’৯১, ’৯৬, ২০০১ এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রয়াত আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন গোলাম মাওলা রনি ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন বাগিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা’র বোনের ছেলে বর্তমান এমপি এস এম শাহজাদা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ নেতা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র কিনলেও এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন ধরে রাখতে সক্ষম হন।
নতুন হিসেবে দলকে পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ রাখতে না পারলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে তার ক্লিন ইমেজ। অপরদিকে তাকে চ্যালেঞ্জ করেও এবার মাঠে নেমেছেন মনোনয়ন বঞ্চিত সাবেক বিজিপি প্রধান লে. জেনারেল (অব:) আবুল হোসেন। এখানেও দলের নেতাকর্মীরা দ্বিধা বিভক্ত। এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেনকে দলের প্রার্থী হিসেবেই মানেন না এস এম শাহজাদা। তিনি মনে করেন, আবুল হোসেন শুধু চাকরি করতেন। আসলে তিনি দলেরই কেউ না। যে কেউ চাইলেই নির্বাচন করতে পারেন। এসব নিয়ে তিনি চিন্তিত নয়।
পটুয়াখালী-৪ আসন (কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী) দু’উপজেলায় দু’টি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ নির্বাচনী এলাকা। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বিশেষ নজর থাকায় কয়েকটি মেগা প্রকল্পের বা¯স্তবায়নসহ নানামুখি উন্নয়নে এ আসনটি খুব সহজেই যে কারো নজর কাড়বে। তাই গুরুত্বপূর্ণ এ আসনটির দখল নিতে সকলেই মরিয়া। এবারও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান এমপি অধ্যক্ষ মহিবুর রহমান মুহিবকে ছাড় দিতে নারাজ তার দলের নেতারা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলের সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক এমপি মাহবুবুর রহমান তালুকদার ও তার ভাই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাবিবুর রহমান তালুকদার ও সাবেক এমপি আনোয়ারুজ্জামান’র ছেলে আব্দুল্লাহ আল ইসলাম লিটন মাঠে নেমেছেন।
ইতোমধ্যে গত ৩ ডিসেম্বর সেনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান’র মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা হলেও অন্য দু’জন আটঘাট বেঁধে মাঠে রয়েছেন। উপজেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত নেতাকর্মীরাও ত্রিধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রতিনিয়ত মুহিব-মাহাবুবের দ্বন্ধ এখন সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। মনোনয়নপত্র জমাদানের দিন থেকে এ পর্যন্ত দু’গ্রæপের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মাহাবুব তালুকদারের দু’সমর্থক হাসপাতালে ভর্তি হলেও শতাধিক নেতাকর্মী আহত হাওয়ার দাবি করছেন তিনি।
অন্যদিকে গত ৩০ তারিখ এলাকায় ছিলেন না বলে দাবি করে মুহিবুর রহমান বলেছেন, ব্যক্তিগত দ্বন্ধের কারণে হাতাহাতির ঘটনা ঘটতে পারে। তবে দলীয় কোনো সংঘাত কিংবা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ কাজী আলমগীর বলেন, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে কেউ সংঘাত কিংবা সহিংসতায় জড়ালে সাংগঠনিকভাবে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।