ভোর হলেই পানির সন্ধানে ছুটতে হয় ।বর্ষা এবং পুকুরের পানিই তাদের একমাত্র ভরসা ।পানি কষ্ট নিবারণে মানুষের দীর্ঘ পথ পায়ে হাটা ।সকাল-বিকাল- দুপুর পানির পাত্র গুলো ঘিরে নারী-পরুষ ও শিশুদের জটলা ।কলসি,বালতি,ড্রাম,জগ,যার যা আছে,তা নিয়ে ছুটে যান পানির কাছে । বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানির কোন বিকল্প নেই। সেই সুপেয় পানির সংকট টাই সবচেয়ে বেশি ।
সুপেয় পানির জন্য তাদের বৃষ্টির অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কোথাও আবার গোসল,রান্নাবান্না আর সেচের পানির কষ্টটা ও তীব্র হয়ে উঠেছে ।খুলনা জেলার পাইকগাছা কয়রা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের চিত্র এটি ।বছরের পর বছর পানি কষ্টে দিন কাটাচ্ছে এই এলাকার মানুষ । ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এ এলাকায় সুপেয় খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে । বহু চেষ্টা হয়েছে,বহু প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে ;কিন্তু পানিকষ্ট ঠিকআগের মতোই রয়ে গেছে,এমনটাই জানালেন এলাকার বাসিন্দারা ।
এসব এলাকায় পানি সমস্যা সমাধানে স্থাপন করা হয়েছে পিএসএফ ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মতো প্লান্ট, যা সংরক্ষণের দায়ভার দেওয়া হয় স্থানীয়দের ওপর। এ কারণে এগুলো নষ্ট হয় দ্রুত। পরে সেগুলো আর মেরামত বা সংরক্ষণ করা হয় না। এছাড়া এনজিওগুলো পৌর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের মাধ্যমে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট, বায়ো স্যান্ড ফিল্টার বসানোর পর সেগুলোও নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতিনির্ভর টেকসই প্রকল্প গ্রহণ না করায় এর সুফল পাচ্ছে না মানুষ।পাইকগাছা -কয়রার বিভিন্ন গ্রামে যে কয়টি পানির প্লান্ট রয়েছে তা থেকে দিনের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয় ভোর থেকে । কার আগে কে যাবে,লাইনে আগে থাকার চেষ্টা সবার ।আগেভাগে খাবার পানির কলসিটা ঘরে তুলতে পারলে
অন্যান্য কাজে সময় দেওয়া সম্ভব হবে ।সকাল ও বিকালে পানির ফিল্টারের কাছে সংগ্রহকারীদের লাইন দীর্ঘ হয় ।পানির সংকট বারো মাসই থাকে ।
তবে মার্চ এপ্রিল ও মে মাসে তীব্রতাটা একটুবেশি ।লতা ইউনিয়নের শেফালী মন্ডল বলেন,চারিদিকে শুধু লোনা পানি, মিঠা পানির পর্যাপ্ত পুকুর না থাকাই বর্ষার পানিই একমাত্র আমাদের ভরসা ।
বর্ষা হলে ড্রামে বা অন্য কোন পাত্রে পানি ধরে রাখতে হয়,যা খাওয়া ও রান্নার কাজে সারা বছর ব্যবহার করতে হয় ।দেলুটি ইউনিয়নের লাকি বেগম জানান,এক কলসি খাবার পানি সংগ্রহ করতে তাদের প্রায় চার কিলোমিটার হাটতে হয় ।আসা যাওয়া যাতায়াত প্রায় আট দশ কিলোমিটার ।যেতে আসতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে ।এক কলসি পানিতে দিন পার হয়না বলে একই সঙ্গে পানি সংগ্রহে ছুটেন আরও দু’তিন জন ।এলাকা ঘুরে জানা যায়,ঘরে একবেলা খাবার যোগাড়ের চেয়েও এই এলাকায় মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানি যোগাড়ে বেশী সমস্যা ।চাল,ডাল,নুন,তেল সবই যোগাড় হলো;কিন্তু ঘরে সুপেয় পানি নেই ।এর মানে সবকিছুই অচল ।গোসল,রান্না করা,থালাবাসন ধোয়া এমনকি গরু-ছাগলওহাঁসমুরগির পিপাসা মেটাতে ভরসা দূর থেকে আনা এই পানি ।খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণে পাথরখালী গ্রাম। নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে বেড়িবাঁধের পাশে মানুষের বসতি। গ্রামের সব নলকূপের পানি লবণাক্ত। এলাকাবাসীকে প্রতিদিন দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। তবে বর্ষাকাল ছাড়া বছরের বাকি সময় তাঁদের পুকুরের পানি পান করতে হয়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ৩৩ শতাংশ মানুষ খাওয়ার পানির সংকটে ভুগছেন। তবে বাস্তবের চিত্র ভিন্ন। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) জরিপের ফলাফল বলছে, খুলনার কয়রা- পাইকগাছা উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করছেন। প্রতি লিটারে এক হাজার মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা পানযোগ্য নয় হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ ওই উপজেলাগুলোর পানিতে প্রতি লিটারে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা আছে। এসব এলাকার ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ নলকূপের পানিতে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।