তিনি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা যার দায়িত্ব। কিন্তু তিনিই কিনা অনিয়ম আর দুর্নীতির চাদর মুড়িয়ে রয়েছেন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায়। নিয়মের বালাই না থাকায় এতিমদশায় পরিণত হয়েছে মাদ্রাসাটি। সেই সঙ্গে শিক্ষার মানও তলানিতে ঠেকেছে। বলছি কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আমিনের কথা।
তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, কমিটি গঠনে নজিরবিহীন স্বজনপ্রীতি, পারিবারিক লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এরই মধ্যে গড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ পর্যন্ত। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা।
অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া যাবতীয় অর্থ লোটপাট, প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র বিক্রি, নিজের স্ত্রীকে শিক্ষিকা বানিয়ে অনুপস্থিত থেকে বেতন উত্তোলন, নৈশ্য প্রহরীর বেতন আত্মসাৎ, আপন বোনকে আয়া পদে নিয়োগ দিয়ে দায়ীত্ব পালন না করে বেতন উত্তোলন, যথাসময়ে অডিট না করা এবং মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা ও বির্তকিত নানা সিদ্ধান্তের কারনে মাদ্রাসাটি এখন অনিয়ম আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। এ কারনে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্টানটির সুনাম নষ্ট হতে বসেছে।
এমতাবস্থায় সুপারের গড়ে তোলা চক্রের অপকর্মের বিশাল মরুভূমিতে পা চালাতে গিয়ে কেউ ছুটেছেন মরীচিকার পেছনে; আবার কেউ ঝরিয়েছেন চোখের জল। অবশ্য শিক্ষার্থীদের আশীর্বাদে সেসব হাজারও ভুক্তভোগীর কান্না ও চোখের জল যেনো দুর্নীতির বিশাল মরুভূমির মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নামে। গতকাল বুধবার ইউএনওর গড়ে দেওয়া তদন্ত কমিটি তার কাছে এইসব অনিয়ম-দুর্নীতির হিসাব চাওয়া।
শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে তার বাবা সাবেক চেয়ারম্যান মৌলানা মুক্তার আহাম্মদ মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাবার অবদান পুঁজি করে ১৯৯২ সাল থেকে মাদ্রাসাটিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দখলে নেন আব্দুল্লাহ আল আমিন। ১৯৯৩ সালে মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন তিনি। নিজের স্ত্রীসহ পরিবারের ৭ জনকে মাদ্রাসাটিতে চাকরি দেন এবং পরিবারের লোকজনকে দিয়ে পরিচালনা পষদ গঠন করে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরী করে মাদ্রাসাটির চার পাশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম কারেন।
সূত্র বলছে, প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আমিনের স্ত্রী জুলেখা বিনতে নাসিম মাদ্রাসার একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষিকা। ২০০৮ সাল থেকে ক্লাসে তিনি অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন উত্তোলন করছেন। তার বোন জান্নাতুল মাওয়া এ্যামি একজন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা। তাকে সামান্য আয়া পদে নিয়োগ দিয়েছেন সুপার আল আমিন। অথচ তিনি কোন প্রকার দায়ীত্ব পালন না করে বেতন নিচ্ছেন হর হামেশাই।
অনুসন্ধানে জানা যায়- মাদ্রাসাটির প্রধান আল আমিন এবং তার অপরাপর অনুগত শিক্ষকদের পরস্পরের যোগসাজসে, স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় নানা অজুহাতে তিন যুগ ধরে মাদ্রাসাটির বিপুল সংখ্যক অর্থ হাতিয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার থেকে দেওয়া ৫ লক্ষ টাকা তিনি একাই মেরে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া ফরম ফিলাপের সময় বিভিন্ন স্তরভেদে শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হবে বলে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারি করেন আল আমিন সিন্ডিকেট। এভাবে গত ৩১ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যায় প্রায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে দাবী করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষর্থীরা।
সূত্রের দাবি, প্রতিষ্ঠানটিতে তার অনুগত না থাকা কোন শিক্ষকদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আল আমিনের পারিবারিক সিন্ডিকেট মাদ্রাসাটি ঘিরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা মৌলবাদী চক্র অন্যদের সহ্য করতে পারছে না। তার মতের বাইরে যাওয়া শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গেলেই যেনো বাঁচে।জানা গেছে, আল আমিন সিন্ডিকেটের কাছে সবচেয়ে বেশি হয়রাণির শিকার হচ্ছেন মেধাবী মুস্টিমেয় কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের যৌন হয়রানি, মানসিক নির্যাতন যেন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শিক্ষার্থীদের সাথে অসৈজন্যমূলক আচরণ, ঘরবাড়িতে গিয়ে হুমকি ধমকিসহ আরও বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের তথ্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। যার অডিও ও ভিডিও রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত আছে। ভিকটিমের আপত্তি থাকায় এবং নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। এছাড়াও ফরিদুল আলম নামের একজন নৈশ্যপ্রহরীর গ্রেডের পুরো টাকা দীর্ঘ বছর ধরে আত্মসাৎ করে আসছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে তার বিরুদ্ধে আসা তদন্ত কমিটিও অনিয়ম-দুর্নীতির ভাগ বাটোয়ারার সমাধান দিতে ব্যর্থ হন।
তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরের গাড়ির মাঠ এলাকায় সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রাণির অভিযোগ উঠেছিল সুপার আল আমিনের বিরুদ্ধে। যৌন হয়রাণির বিষয়টি পুলিশকে মৌখিকভাবে অবগতের পর ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে পালিয়ে যায় মাদ্রাসার সুপার আব্দুল্লাহ আল আমিন। তখন ভুক্তভোগী পরিবারটি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ছয়টি ভাড়া বাসা রয়েছে গাড়ির মাঠ এলাকায় আল আমিনের। সবক’টি বাসা ভাড়া দিলেও নিজের বিশ্রামের জন্য একটি ঘর খালি রাখা হয়।
ওইদিন বিকালে গাড়ির মাঠ আসেন আল আমিন। সেখানে বিভিন্ন কৌশলে ভাড়াটিয়ার এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন হয়রাণির চেষ্টা করেন। প্রথমে ল্যাপটপের মাধ্যমে যৌন ইঙ্গিত মূলক ছবি ও ভিডিও দেখান কৌশলে। এরপর ওই ছাত্রীকে আদরের নামে চুমু দেন। এরপর কাপড় খোলার চেষ্টা করলে ওই ছাত্রী চিকিৎকার দিয়ে চলে যায়। বাড়ির মালিকের এমন কর্মকান্ডের বিষয়টি পরিবারকে অবগত করেন ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগি পরিবারটি আশ্রয় হিসেবে কক্সবাজার সদর থানায় মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেন। মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে সেদিন রাত ১২ টার দিকে সদর থানার তৎকালিন দায়ীত্বে থাকা এসআই আক্তারুজামানসহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী ও পরিবারের সাথে কথা বলেন। পুলিশ যাওয়ার আগেই পালিয়ে যান আল আমিন। এই ঘটনা জেলাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। একজন মাদ্রাসা প্রধানের এমন ঘৃনিত কর্মকান্ডে নিন্দার ঝড় উঠে সর্বত্রে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, শেখ রাসেল স্মৃতি ল্যাবের জন্য সরকার থেকে দেওয়া ১৩ টি ল্যাপটপ বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। প্রধান শিক্ষক আল আমিন টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানের সবকিছু বিক্রি করে যাবতীয় টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশনে সরকারের বেধে দেওয়া টাকার কয়েকগুন বেশি টাকা নেন। নিয়োগ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন তারা। গরমে কষ্ট হলেও শ্রেণিকক্ষে ফ্যান চালাতে দেন না প্রধান শিক্ষক। শিক্ষার বিষয়ে ঠিকমতো তদারকি করেন না। এমনকি এত বড় প্রতিষ্ঠানের কোন কোন কক্ষে ফ্যান পর্যন্ত নেই। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো হুমকি-ধামকি দেন প্রধান শিক্ষকসহ তার লাঠিয়াল ভাইয়েরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের প্রধান শিক্ষক মাদ্রাসাটির দায়িত্ব থাকা অবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম করে গেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে ভুল করে তা টাকার বিনিময়ে সংশোধন করতেন। দীর্ঘদিনের মাদ্রাসার হিসাব তিনি কর্তৃপক্ষকে দেননি। এছাড়া আরও বিভিন্ন অভিযোগে ইউএনও এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর অভিযোগ করা হয়। গতকাল অভিযোগ তদন্তে এলে প্রধান শিক্ষক অভিযোগের কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় কয়েকদিন সময় চেয়েছেন।
তারা আরও জানান, প্রধান শিক্ষক কৌশল পরিবর্তন করে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকসহ সিন্ডিকেট করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়, বিনা রশিদে অর্থ আদায়, ভুয়া বিল করে টাকা আত্মসাৎ, কোচিং বাণিজ্য, উপবৃত্তির শিক্ষার্থী নির্বাচনে অনিয়মসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন যুগযুগ ধরে। এমনকি মাদ্রাসাটির শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকলে ছাত্রছাত্রী ও এলাকাবাসী প্রধান শিক্ষক আমিনের পদত্যাগসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু জেলা শিক্ষা অফিসার নাছির উদ্দিনের নিকটতম আত্মীয় হওয়ায় তার ছত্রছায়ায় প্রধান শিক্ষক নির্বিঘ্নে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় বলে দাবি করেন তারা।
শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রধান শিক্ষক কখনো শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করতেন না। এমনকি এসব অনিয়ম নিয়ে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে উল্টো তার ভাইদের দিয়ে হুমকি-ধামকি ও নানাভাবে হয়রানি করা হতো। এছাড়া কয়েক বছর থেকে মাদ্রাসাটির শিক্ষার মান কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। উপজেলা পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে থাকা এ প্রতিষ্ঠানটি বিগত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে উপজেলা পর্যায়ে একদম নিচে নেমে আসে।
স্থানীয় অভিভাবকদের দাবি, মাদ্রাসাটিতে সুপারের একক আধিপত্য। তার কথাই যেন শেষ কথা। তার আঙ্গুলের ইশারায় হতো সকল কাজ। প্রভাব এবং আধিপত্যের জোরে তটস্থ রাখে তার অধীনস্থ সবাইকে। ১৯৯২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার মিলিয়ে আল আমিন নিজের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে চলেন সব সময়। দায়িত্বে থাকা সুপার তার মাথায় ঘুরপাক খেতো মাদ্রাসার কাজ কার। তিনি যে রক্ষার দায়ীত্বে রয়েছেন সেটা যেন ভুলেই গেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় তিনি যেন দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছেন।
স্থানীয়দের মতে, সম্প্রতি আল আমিনের অপসারণ চেয়ে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে তার এইসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে প্রশাসন। কিন্তু সেখান থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত তার মামা-ভাইদের নিয়ে মোটা অংকের টাকার মিশন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করতে মাঠে নামে।মাদ্রাসাটির সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, দুর্নীতির বরপুত্র বলা হয় সুপার আল আমিনকে। বাবার অবদান আর নীতি-নৈতিকতার চাদর মুড়িয়ে তিন যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। নিয়োগ জালিয়াতি, নথি গায়েব ও এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) নকলসহ তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অন্তত কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর সেইসব টাকা খরচ করে অভিযোগের পাহাড় ধামাচাপা দেবেন। তার বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে মনে হচ্ছে না।