ফরিদপুরের শেখর ইউপির গরিবের চাল ডাল চেয়ারম্যানের পকেটে যাওয়ার অভিযোগ

নাজিম বকাউল প্রকাশিত: ৬ জুলাই , ২০২৪ ১৬:৩১ আপডেট: ৬ জুলাই , ২০২৪ ১৬:৩১ পিএম
ফরিদপুরের শেখর ইউপির গরিবের চাল ডাল চেয়ারম্যানের পকেটে যাওয়ার অভিযোগ
প্রথমবার সহযোগিতা পেলে ও বন্ধ হয়ে যায় সেই ভাগ্যের দুয়ার। কেড়ে নেওয়া হয় তার সহায়তা কার্ড। এরপর তারনামে প্রতিবারই আসতে থাকে সরকারি চাল, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ কিন্তু একবারও পৌছেনি তার হাতে।শুধু রোকেয়া বেগম নয়- এই ইউপিতে এমনই ৪০জন ব্যক্তির নামে মাসের পর মাস আসতে থাকে সরকারি সহযোগিতা। তাদের মধ্যে অনেকেই জানেনই না তার নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকায় রয়েছে তাদের নাম।

হতদরিদ্র কৃষক স্বামীর সংসারে সরকারি সহযোগিতা পেতে বিগত প্রায় দুইবছর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দ্বারস্ত হয়েছিলেন রোকেয়া বেগম (৫২)। ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে আকুতি মিনতিতে পাঁচশ টাকার বিনিময়ে পেয়ে যান একটি ভিজিডি কার্ড।

প্রথমবার সহযোগিতা পেলে ও বন্ধ হয়ে যায় সেই ভাগ্যের দুয়ার। কেড়ে নেওয়া হয় তার সহায়তা কার্ড।  এরপর তারনামে প্রতিবারই আসতে থাকে সরকারি চাল, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ কিন্তু একবারও পৌছেনি তার হাতে।শুধু রোকেয়া বেগম নয়- এই ইউপিতে এমনই ৪০জন ব্যক্তির নামে মাসের পর মাস আসতে থাকে সরকারি সহযোগিতা। তাদের মধ্যে অনেকেই জানেনই না তার নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকায় রয়েছে তাদের নাম।

এইকার্ডের উপকারভোগীদের পরিবর্তে বরং সেই চাল-ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ যাচ্ছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ৮নংশেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ ও পরিষদের সদস্যদের পকেটে।সরেজমিনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে না গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অফিসকে ইউপি কার্যালয়ে রুপান্তরিত করেছেন।ওই ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্যার স্ত্রী রোকেয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, অনেক ঘুরে চেয়ারম্যানকে পাঁচশ টাকা দিয়েএকটা কার্ড পাইছিলাম।

কিন্তু তা আমারে অন্যএকজনের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে বলে চেয়ারম্যান এবং তার কাছ থেকে বাকি ২৫০ টাকা নিয়ে নিতে বলে। কিন্তু ওই লোক ভাগে নিতে চায় না। বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানকে জানালে সে আমাকে রাগ করে বলে ভাগে খাইলি খাবা, নইলে যাও। পরে নত হয়ে একবার আনলাম। পরে আমি চৌকিদারকে (গ্রামপুলিশ) বললে, চেয়ারম্যান আমার উপর আর ও রেগে যায়। এরপর আমার কার্ড রেখে বের করে দেয়। তারপর আজ ১৮/১৯ মাস কোনো চাল-ডাল দেয়না। 

রোকেয়া বেগমের মতো এই ইউনিয়নের ৪০ জনের নামে ভিজিডি কার্ড রয়েছে। তাদের নামে আসা সকল চাল, ডাল আত্মসাৎ করছেন চেয়ারম্যান নিজেই। বিষয়টি অনেকেই জানতে পেরে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগও  দিয়েছেন। মাসের পর মাস সরকারি রিলিফের খাদ্যসহায়তা না পেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন পরিবারগুলো। ওই লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখর ইউনিয়নে ২৪০টি ভিজিডি কার্ড রয়েছে।

এর মধ্যে ইউপি সদস্যদের ৫/৬টি করে কার্ড দিয়ে নিজে কিছু বিতরণ করেছেন। বাকিগুলো বিভিন্ন মানুষের নামে কৌশলে ইস্যু করে চেয়ারম্যান আত্মসাৎকরছেন।এই অভিযোগপত্রে ৩০ জন স্বাক্ষর করেন।এই সুবিধাভোগীদের তালিকার ২৪০ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই জানেনা তাদের নামে ইস্যু হওয়ার কার্ডের খবর। এদের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে পাঁচশত টাকাসহ তাদের ভোটার আইডিকার্ড, ছবি দিয়েছিলেন ইউপিসদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে। কিন্তু পরবর্তিতে তারা জানতেই পারেনি তাদের নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে।

ভিজিডি কার্ডের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে নিজের ও স্বামী বিল্লাল শিকদারের ছবি দিয়েছিলেন রাখালতলী গ্রামের জোসনা বেগম। এরপর জানতে পারেনি তার নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু ভিজিডি কার্ডের তালিকায় ১২৩ নম্বরে নাম রয়েছে তার।এই নারী বলেন, আমাগো নাম ও ছবি নিয়েছিল কিন্তু আজওআমরা কিছু পাইনি।কার্ড হয়েছে কি-না তাও আমি বলতে পারব না। এই ভিজিডি কার্ডের তালিকা ধরে যাওয়া হয় ইউনিয়নের বারাংকুলা গ্রামের মোঃ দেলোয়ার কাজীর বাড়িতে।

বাড়ির চারদিকে টিনেরবেড়া দিয়ে ঘেরা, ভেতরে আধাপাকা জোড়ঘর রয়েছে, দেখে মনে হবে না কোনো হত দরিদ্রের বাড়ি। অথচ ওই তালিকায় ১২৭ নম্বরে দেলোয়ার কাজীর স্ত্রী লিমা সুলতানার নাম রয়েছে। বিষয়টি জানতে চাইলে দেলোয়ার কাজী হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি জানেই না তার স্ত্রীর নামে ভিজিডি কার্ড রয়েছে।তিনি বলেন, আমার জানা মতে কোনো কার্ড নেই। এমনকি কোনো সুবিধাও পাইনি। আমিতো কখনও আবেদনই করি নাই। আল্লাহ জানে কেমনে কিহয়েছে? এটা যে করেছে সে অবশ্যই অপরাধ করেছে।

ব্যক্তিগত অফিসই পরিষদ, জনগণের ক্ষোভ: ২৯ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত শেখর ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার।ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়টি ৮নংওয়ার্ডের চরশেখর গ্রামে।গ্রামটি ইউনিয়নের মধ্যবর্তীস্থানে অবস্থিত। এ গ্রামের নামেই নামকরণ করা হয়েছে ইউনিয়নের।২০১০-১১ অর্থবছরে ইউনিয়ন কার্যালয়ের আধুনিকায়ন করে নির্মিত হয় দুইতলা বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ইউপি কমপ্লেক্স যেন এখন জরাজীর্ণ ও জনশূণ্য একটি ভূতুরে ভবনে রুপান্তরিত হয়েছে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর একদিনও সেখানে অফিস করেননি কামাল আহমেদ। এমনকি সেখানে কোনো কার্যক্রমই নেই। এই সুযোগে ভবনটিতে অনেকেই গরুছাগল  পালনের কাজে ব্যবহার করছে।অথচ সহস্রাইল বাজারে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলেছেন ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে। দোতলা বিশিষ্ট ভবনের নিচতলায় বসার জায়গা করা হয়েছে কম্পিউটার অপারেটর ও সচিবের। সকল কার্যক্রমই সেখানে করা হয়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত আড়াই বছর নির্বাচিত হলে ও একদিনের জন্য ও এখানে অফিস করেননি। যে কারনে হয়রানির শিকার হচ্ছে অনেকেই। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অফিসে গেলে সচিব ও অন্যরা বাড়তি টাকা ছাড়া কাজ করেনা।দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব বেলায়েত শেখ বলেন, আমাদের দাদার আমল থেকেই এখানে ভোট অফিস দেখে আসতেছি। এ পর্যন্ত যারাই চেয়ারম্যান হয়েছে সকলে এখানেই অফিস করেছে। কিন্তু এইলোক হওয়ার পরে তার চেহারাই আমি দেখি নাই। কি জন্যএই অফিস বন্ধ হয়ে গেছে আমরা জানি না। আমাদের বাড়তি টাকা দিয়ে তার অফিসে যেতে হয়।সেখানে গেলেও বাড়তি টাকা গুনতে হয়।টাকা ছাড়া কোনো কাজই করতে চায়না।

এসব বিষয়ে জানতে ইউপি চেয়ারম্যান মোঃকামাল হোসেনের ব্যক্তিগত অফিস সস্রাইলবাজারে যাওয়া হয়।সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইউপি সচিব বসে অফিস করছেন। এরপরই ওই ইউপি সচিব সেখান থেকে আড়াল হয়ে যান। এর কিছুক্ষনের মধ্যে উপস্থিত হোন চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন।তিনি বলেন, কার্ড আত্মসাত করা কোনোভাবেই সম্ভবনা। যতগুলো কার্ড রয়েছে প্রত্যেককেই দেয়া হয়। যত মালামাল আসে সবই সঠিকভাবে বন্টণ করা হয়েছে। সাধারন মানুষের ১০কেজি চাউল চেয়ারম্যান মেরে দেবে, এটা আমার মাথায় আসেনা। আমার বরাদ্দের বেশি থেকেও মানুষকে দিয়ে থাকি।তিনি দাবি করে বলেন, এলাকায় দলপাল্লা থাকে, সে কারনেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোঃকামরুল আহসান তালুকদার বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত হবে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের একজনকে কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিবে।এতে দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo