বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম, যিনি নুরউদ্দিন জাহাংগীর নামে পরিচিত। বিটিভির সদর দপ্তরে ১২ তলায় অবস্থিত ৩ টি গেস্ট রুম দখল করে বাসা বাড়ি বানিয়েছেন। সেখানে দিনে-রাতে তার স্ত্রী এবং তার ২ সন্তান অবস্থান করে। যা বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে বিটিভির কোন মহাপরিচালক এখানে রাত্রী যাপন করেননি!
বিটিভিতে বেতন আটকানো। গেস্টদের টাকা বকেয়া অনেকদিন। বিটিভির সব ধান্দাপাতি বিল ঘু‘ষ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট ম্যানেজ করেন দুর্নীতির দায়ে দুর্নীতি দমন কশিশনের তদন্তের আওতাধীন থাকা বিটিভির জিএম মাহফুজা আক্তার।
ডিজির স্ত্রীর কাছে ঘুষের সেই টাকা পৌঁছে দেয় জিএম মাহফুজা। আর এই লেনদেনগুলো হয় মহাপরিচালকের দখল করা গেস্টরুম কাম বাসায়।
বিটিভির দুর্নীতির রাণী মাহফুজা আক্তারঢাকা: বিটিভি যেন পরিণত হয়েছে দুর্নীতিতে। আর সেই দুর্নীতির রমরমা চলছে ঢাকা কেন্দ্রের সাময়িক চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত (যার মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ) জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তারের নেতৃত্বে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ২১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতোমধ্যে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক নাঈমুল ইসলামকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি নাঈমুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মাহফুজা আক্তারের দুর্নীতির বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছে।
এদিকে কমিশনের পক্ষ থেকে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মাহফুজা আক্তারের বিষয়ে যে সকল তথ্য ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা সেগুলো হলো-:
মাহফুজা আক্তার ঢাকা কেন্দ্র, ঢাকা এর ব্যক্তিগত নথির ছায়ালিপি। ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের তথ্য এবং বাজেট ব্যয়ের পর দাখিলকৃত প্রতিবেদনের কপি। ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (সংশোধিতসহ) ৪) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম বাংলো মেরামতের খরচের তথ্য। ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রে কতগুলো সাপ্তাহিক ও ধারাবাহিক নাটক এবং অনুষ্ঠান নির্মাণ হয়েছিল সে সংক্রান্ত তথ্য। ২০১৪-২০১৯ পর্যন্ত মাহফুজা আক্তার কর্তৃক ঢাকা কেন্দ্রে প্রযোজনাকৃত ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটকের তালিকা।
এ ব্যাপারে উল্লেখিত তথ্য ও রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি আগামী ১১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বরাবর প্রেরণ করার জন্য দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের টেলিভিশনের ৬০ বছরের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মাহফুজা আক্তার বাংলাদেশ টেলিভিশনে গত কয়েক বছরে দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাহফুজা আক্তারের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তার সাময়িক চলতি দায়িত্বের মেয়াদ ৬ মাস আগেই শেষ হয়েছে। বর্তমানে তিনি অবৈধভাবে পদে বহাল রয়েছেন।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিটিভির রেকর্ড ভঙ্গ করে শিল্পী সন্মানী খাত থেকে ১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের নামে বিশাল অংকের টাকা ঢাকা কেন্দ্রের হিসাব শাখার দুর্নীতিবাজ ৩ জন কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশে লুটপাট করেছেন। যার ফলে বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীদের সন্মানী ৬ মাসেরও বেশি বন্ধ ছিল। যা বিটিভির জন্য নজিরবিহীন ঘটনা। এই বেআইনি অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য বিটিভির সদর দপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কমিটি রিপোর্ট প্রদান করলেও বিটিভির বর্তমান মহাপরিচালক রহস্যজনক কারণে রিপোর্টের ভিত্তিতে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। রিপোর্টটি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
আরও জানা যায়, সরকারি বিধিমালায় নির্ধারিত বাজেটের বিপরীতে অতিরিক্ত খরচের বিধান না থাকলেও মাহফুজা আক্তার ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্পী সন্মানীর ৫৮ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে ভুয়া অনুষ্ঠানের বিল-ভাউচার তৈরি, বিশেষ অনুষ্ঠানের নামে মাত্রাতিরিক্ত বাজেটের অনুমোদন দিয়ে ৭-৮ জন প্রযোজক ও হিসাব শাখার কর্মকর্তাদের সাথে মিলে ১৩ কোটি টাকারও বেশি খরচ করে সেখান থেকে ৫ কোটিরও বেশি অর্থ লুটপাট করেছেন। যা দুদকের তদন্তের আওতায় আনা উচিত বলে বিটিভি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
শুধু তাই নয়, এই অতিরিক্ত খরচের ১৩ কোটি টাকা পরবর্তী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন ছাড়াই (যা বাধ্যতামূলক) বেআইনিভাবে মাহফুজা আক্তার জিএম হিসেবে সমন্বয় করেছেন যা দণ্ডনীয় অপরাধ। মাহফুজা আক্তারের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রে এক ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা বিরাজ করছে। বিটিভির বর্তমান মহাপরিচালকও তার কথার বাইরে কোনো কাজ করার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে জানা গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মহাপরিচালক তার অধীনে কর্মরত।
এদিকে, মাহফুজা আক্তার ও কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিটিভি ও দুর্নীতি আজ সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রে সংগীত শিল্পী ও সুরকারদের তালিকাভুক্তিকরণ বা অডিশন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পী, নাট্যকার, গীতিকার, পান্ডুলিপি রচয়িতা ও কলাকুশলী তালিকাভুক্তি এবং গ্রেডেশন নির্ধারণ সংক্রান্ত নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনো প্রকার কমিটি গঠন ছাড়াই অডিশন নীতিমালা লঙ্ঘন করে গান ও সুরকারদের সম্প্রতি তালিকাভুক্ত করেছেন। এই অডিশনের কথিত সদস্য সচিব মোল্লা আবু তৌহিদ ও তার সহযোগী যন্ত্রশিল্পী সুমন রেজা পাইকারিহারে টাকার বিনিময়ে শিল্পীদের অডিশনে পাশ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে।এ ব্যাপারে টাকার বিনিময়ে শিল্পী নির্বাচনের লক্ষে বিভিন্ন জনকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন মোল্লা আবু তৌহিদ। ক্ষেত্র বিশেষে একেকজনের নিকট থেকে ২০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। যা বিটিভির ইতিহাসে অভাবনীয় ও নজিরবিহীন ঘটনা।
অন্যদিকে বিটিভির মহাপরিচালক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী অনুষ্ঠান ও অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে অডিশনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনেছেন। ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময়ে তড়িঘড়ি করে অডিশনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে যা রহস্যজনক। অন্যদিকে অডিশনের নীতিমালার "ঝ" ধারা অনুযায়ী অডিশনের কোনো কার্যক্রম টেলিভিশনে সম্প্রচার করা যাবে না মর্মে সুনির্দিষ্টভাবে বলা থাকলেও বিটিভির মহাপরিচালকের মৌখিক নির্দেশে মাহফুজা আক্তার অডিশনের কার্যক্রম নিয়ে ১০০ এরও বেশি অনুষ্ঠান নির্মাণ করে বেআইনিভাবে বিটিভিতে সম্প্রচার করছেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা বাজেট করে এখান থেকেও অর্থ লুটপাট করা হয়েছেঅনুসন্ধানে আরও জানা যায়, গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস ও ২৫ ডিসেম্বর বিটিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের নামে ব্যাপক অর্থের অপচয় ও লুটপাট করা হয়েছে। জাপানী সংস্থা "জাইকা"র এইচডিটিভি নামে একটি প্রকল্প থেকে মাহফুজা আক্তার তেমন কোনো কাজ না করেই কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিটিভিকে নির্বাচনী বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও নির্বাচনের দিন বিভিন্ন খরচ বাবত ২৬ লক্ষ টাকা প্রদান করেছে। কিন্তু মাহফুজা আক্তার সমস্ত টাকা উত্তোলন করে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। অল্পকিছু টাকা বিটিভির কিছু নষ্ট গাড়ি মেরামত বাবদ খরচ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে সংসদ নির্বাচনের আগে ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিটিভিতে এসেছিলেন জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য ধারণ করার জন্য। এজন্য নির্মিত সেটে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা ও আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। যার অনুমোদন দিয়েছিলেন জিএম হিসেবে স্বয়ং মাহফুজা আক্তার। বিষয়টি শেষ মুহূর্তে বিটিভির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও এসএসএফের নজরে এলে দ্রুত তা সংশোধন করা হয়।এ বিষয়ে মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে বাংলাবার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিব না।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার মো.জহুরুল হক বাংলাবার্তাকে বলেন, কমিশন থেকে যতদূর জানি চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুর্নীতি করলে মামলা হবে। কোনো দুর্নীতিবাজ অপরাধ করলে পার পাবে না। কিঞ্চিত দুর্নীতি করলেও মামলা হবে। আমরা আমাদের কাজ শেষ করার পর বাকিটা বলতে পারবো।