অটোরিকশা চালক গ্রেপ্তারের পর পালিয়েছে সাবেক ইউপি সদস্য
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও ইউনিয়নের পাঁচদোনা গ্রামের শিশু আদিবা হত্যার পর গ্রেপ্তার হয় তিন আসামী। এদের মধ্যে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক আউয়াল গ্রেপ্তারের পর স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য শুক্কুর আলী প্রধানিয়া নিজ বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। তার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এই হত্যাকান্ডের রহস্য ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে।
অনুসন্ধান ও ঘটনার বিবরণে জানাগেছে, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি বিকেল আনুমানিক ৪টার দিকে প্রবাসী আলাউদ্দিন এর শিশু কন্যা আদিবা (৮) কে একই গ্রামের প্রধানিয়া বাড়ীর মো. মজিব ফকিরের ছেলে মো. ইমন (২১) ও সরকার বাড়ির মো. লিটন সরকারের ছেলে মো. ইয়াছিন (২০) বাড়ির সামনে থেকে ফুল দিবে বলে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওই সময় আদিবা চাচাত বোন তাসফিয়ার সাথে খেলাধুলা করছিল।
আদিবাকে ফুল দেবার কথা বলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আদিবার মার কাছে এসে জানায় সাথে থাকা তাসফিয়া। এরপরে তাসফিয়ার মা সামীমা আক্তার মেয়েকে খুঁজতে বাড়ি থেকে বের হন। তিনি বাড়ির আশপাশে, ইমন ও ইয়াছিনদের বাড়িতে গিয়ে অনেক খুঁজাখুঁজি করে আদিবাকে পাননি। সর্বশেষ আদিবার মা মতলব দক্ষিণ থানায় ওইদিন রাতে লিখিত অভিযোগ করেন।
এদিকে অভিযোগের ভিত্তিতে মতলব দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালেহ আহম্মেদ বিষয়টি তদন্ত করার জন্য দায়িত্ব দেন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. জালাল উদ্দিনকে।
পরবর্তীতে ওসির নির্দেশনায় এসআই জালাল উদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্সসহ ২৩ জানুয়ারি অভিযুক্ত ইমনের বাড়ীর উত্তর পশ্চিমে নিজস্ব বাঁশঝাড়ের নীচে পচা ময়লারস্তুপ থেকে আদিবার মরদেহ উদ্ধার করে। এছাড়া অভিযুক্ত আসামী ইমন ও ইয়াছিনকে গ্রেপ্তার করে।
তবে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার শ্রীকান্দি এলাকার সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক আউয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর হত্যার ঘটনাটি ভিন্ন দিকে মোড় ঘুরে। কারণ আউয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই হত্যার শিকার শিশু আদিবার প্রতিবেশি স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য শুক্কুর আলী প্রধানিয়া পলাতক রয়েছেন। তবে তিনি এই মামলায় এজহারভুক্ত আসামী কিংবা তাকে কোনভাবে অভিযুক্তও করা হয়নি।
সাবেক এই ইউপি সদস্য শুক্কুর আলী কেন বাড়ি থেকে পলাতক; এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানাগেছে বিভিন্ন তথ্য।
শিশু আদিবার পিতা আলাউদ্দিন বর্তমানে প্রবাসে। তিনি পাঁচদোনা নানার বাড়ীতে বড় হয়েছেন এবং পরবর্তীতে এখানে বসতি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন। দীর্ঘ বছর এই এলাকায় থাকার সুবাধে আলাউদ্দিন সামাজিকভাবেও বিভিন্ন কাজে জড়িয়েছেন। এরই মধ্যে সাবেক ইউপি সদস্য শুক্কুর আলী পরিবার আলাউদ্দিন পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ এনে একাধিক মামলা করেন। এসব মামলায় আলাউদ্দিন পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করতেন, সেই ব্যবসাও বড় ধরণের ক্ষতি হয়। উপায় না পেয়ে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু শুক্কুর আলী গংদের অন্যায়, অত্যাচার ও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি।
আদিবার মা ও মামলার বাদী সামীমা বলেন, আমার মেয়েকে হত্যার পর এবং অটোরিকশা চালক আউয়াল গ্রেপ্তারের পর থেকে শুক্কুর আলী বাড়ি থেকে পলাতক। সে অটোরিকশা চালক আউয়ালকে জামিন করানোর জন্য একজন আইনজীবী দিয়ে চেষ্টা চালায়। আমাদের মামলায় শুক্কুর আলী পরিবারের কেউ এজহারভুক্ত আসামী না। যে কারণে আমার শিশু কন্যা আদিবা হত্যাকান্ডে তারা জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহ হয়। কারণ শুক্কুর আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করে ব্যাপক হয়রানি করে। এক মামলায় আমাকেও আসামী করে।
তিনি আরো বলেন, আমার মেয়েকে অপহরণকারী ইমন পরিবারের সাথে আমাদের কোন ধরনের বিরোধ ছিলো না। ইমন আমাদের এলাকার ছেলে। সে আমার বাড়ির কাছে এসে প্রায় আড্ডা দিয়েছে। লোকজনের মুখে শুনেছি সে মাদকাসক্ত। ঘটনার কিছুদিন আগে এলাকায় আসে। আমাদের সাথে পূর্ব থেকে যাদের বিরোধ, তারাও ইমনকে আদিবা হত্যায় ব্যবহার করতে পারে!
সামীমা আরো বলেন, শুক্কুর আলী এলাকায় একজন প্রভাবশালী। তিনি প্রভাব খাটিয়ে আমাদের পরিবারের অনেক ক্ষতি করেছেন। আর তার এই কাজে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে তার প্রবাসী ভাই মোশারফ হোসেন ওরফে মোশন আলী।
আদিবার মা বলেন, অপহরণের রাতেই অভিযুক্ত ইমনের বাবা মজিব ফকির কবিরাজি তদ্বির দিয়ে আদিবাকে খুঁজে দেয়ার নাম করে আমাদের বাড়িতে আসে। তার এই তদ্বিরে আমাদের পরিবারের সদস্যরা অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখনো আমরা অসুস্থ ও শোকাহত।
অপরদিকে আদিবা হত্যার বিষয়ে এলাকার একাধিক ব্যাক্তির সাথে কথা হয়। যারা মরদেহ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থল এলাকায় উপস্থিত ছিলেন।
হত্যার শিকার আদিবার বাবার মামা আব্দুল হক বলেন, যেদিন আদিবার মরদেহের খোঁজ মিলে, ওইদিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশে অনেক খুঁজাখুজি করে। সর্বশেষ পুকুরের পাড় থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। ওই সময় আমি নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তবে মামলা হওয়ার পর জানতে পারি প্রধান আসামী ইমনের বসতবাড়িতে কে বা কারা আগুন দেয়। তখন আমরা মরদেহ ময়না তদন্ত ও মামলার কাজে চাঁদপুরে ব্যস্ত। কিন্তু ইমন পরিবার পরিকল্পিতভাবে আদিবা হত্যার মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমাদের বিরুদ্ধে একটি সাজানো মামলা করে।
আদিবার প্রতিবেশি এনামুল হক ব্যাপারী বলেন, আদিবার মরদেহ উদ্ধারের সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। পুলিশ আমাদের সাথে কথা বলেছে। একসময় তার মরদেহের সন্ধান মিলে। তখন এখানে অনেক মানুষের উপস্থিতি ছিলো। আর ওই স্থানটি আদিবার বাড়ি থেকে খুব নিকটে হলেও খুবই নির্ঝন স্থান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযুক্ত আসামী ইমন কিংবা তার পরিবারের সাথে আদিবার পরিবারের কোন ধরনের বিরোধ কিংবা শত্রুতা ছিলো বলে জানা নেই। তবে কি কারণে এই হত্যাকান্ড তা এখনো স্পষ্ট না।
অভিযুক্ত আসামী ইমনের বাড়ির সম্পর্কে দাদা খলিল প্রধানিয়া বলেন, পুলিশ যখন আসে তখন অনেক মানুষের উপস্থিতি ছিলো। তারা আশপাশে ও পুকুরে অনেক খুঁজাখুঁজি করে। আমিও ওই সময় আসি। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ইমন ও তার পরিবার যেন এই বাড়িতে আর না আসে। তার অপরাধে যেন যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসি হয়, আমিও এমন বিচার দাবী করি।
আসামী ইমনের বাড়িতে গিয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হয় বেশ কয়েকজনের সাথে। ইমন পরিবার খুবই দুষ্টু প্রকৃতির তার প্রমাণ বাড়ির লোকদের আচরণে। তবে কেউ তাদের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। নাম প্রকাশ না করে একজন বলেন, ইমনের বাবা তার আপন চাচা ব্যাংকার শহীদুল ইসলাম প্রধানের ঘরে থাকতেন। তিনিই তাদের পরিবারের কর্তা।
এদিকে শিশু আদিবা হত্যাকান্ডের ঘটনা জানাজানি ও মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর ক্ষিপ্ত হয় এলাকাবাসী। তবে ওই সময় ইমন পরিবারের সদস্যদের পরিকল্পনায় তাদের ঘরে আগুন দেয়া হয়। আগুন দেয়ার পূর্বে ইমনের বোনসহ কয়েকজন তাদের ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে নেয়। এই বিষয়টি সঠিক তদন্ত করা হলে আগুনের মূল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে জানান এলাকাবাসী।
শিশু আদিবা অপহরণের সময় সাথে ছিলো চাচাত বোন তাসফিয়া। তাসফিয়ার বক্তব্য একই। সে ঘটনার পর যে বর্ননা দিয়েছেন, গনমাধ্যমেও একই কথা বলেছেন। অর্থাৎ আদিবাসহ সে বাড়ির সামনে খেলাধুলা করছিল। তখন ইমন তাকে ফুল দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। আর এই কথাই প্রথম তাসফিয়া আদিবার মাকে জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা জামাল উদ্দিনের সাথে সাক্ষাত হয় আদিবার কবরের পাশেই। তিনি বলেন, এই ঘটনার বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সবই জানেন। তিনিও এই ধরণের ঘটনায় জড়িত আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।
মতলব দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালেহ আহম্মেদ বলেন, শিশু আদিবা হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি খুবই গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিনজন আসামী গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে একজনের ১৬৪ জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তবে আরেকজন আসামী সন্দেহজনক রয়েছে। তদন্ত চলমান থাকায় আপতত এর চাইতে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।