দেশের অন্যতম বৃহৎ জেলা কুমিল্লা। জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটির সীমান্ত রয়েছে পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারিদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
দেশের অন্যতম বৃহৎ জেলা কুমিল্লা। জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটির সীমান্ত রয়েছে পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারিদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তের অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে মাদকের চোরাচালান চলে।
মাদক কারবারিরা এতই বেপরোয়া যে কেউ প্রতিবাদ করলে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটায়। হামলা চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপরও।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একের পর এক অভিযানেও কমছে না সীমান্তে মাদকের কারবার।
পুলিশ সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কুমিল্লা জেলার ৮২ জন মাদক কারবারি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের নাম প্রকাশ করা হয়।
তখন সীমান্তের পাঁচ উপজেলায় ব্যাপক অভিযান চলে। ওই তালিকায় বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার নামও বেরিয়ে আসে তখন। এরপর ওই সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় তালিকাভুক্ত ২২ মাদক কারবারি। জেলায় র্যাব, বিজিবি, থানা পুলিশ, ডিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার হচ্ছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন সদর সার্কেল দৈনিক চৌকস ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থার প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যে জেলায় মাদক জব্দ ও মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হচ্ছে না। মাদক কারবারিদের অপতৎপরতা বেড়েছে। তবে আমরাও বসে নেই। মাদকের সঙ্গে জড়িতরা যতই শক্তিশালী হোক, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’
অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে মাদক
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লা সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম ও সদর দক্ষিণ উপজেলার সীমান্তবর্তী অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে অবাধে আসছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদসহ নানা মাদকদ্রব্য।
এ ছাড়া বিয়ার ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন পণ্য ভারত থেকে চোরাকারবারিদের মাধ্যমে দেশে ঢুকছে।
ওই পাঁচটি উপজেলার উল্লেখযোগ্য ও পরিচিত কয়েকটি পয়েন্ট হচ্ছে বুড়িচংয়ের চড়নল, বারেশ্বর, সংকুচাইল, রাজাপুর, হায়দ্রাবাদনগর; ব্রাহ্মণপাড়ার শশীদল, আশাবাড়ি, নয়নপুর, তেতাভূমি; কুমিল্লা সদরের বিবিরবাজার, বৌয়ারা, গোলাবাড়ি, সাহাপুর, শিবের বাজার;
সদর দক্ষিণের একবালিয়া, তালপট্টি, সুবর্ণপুর, চৌয়ারা, যশপুর, শ্রীপুর, কনেশতলা, দড়িবটগ্রাম, রাজেশপুর; চৌদ্দগ্রামের গোমারবাড়ি, আমানগণ্ডা, ছফুয়া, জগন্নাথদীঘি, গোলপাশা, বসন্তপুর, সাতবাড়িয়া, পানপট্টি, তারাপুর, কাইচ্ছুটি, কোমারডোগা ও পদুয়া।
ব্রাহ্মণপাড়ার শশীদলের কাছে হরিমঙ্গল, বাগরা, গঙ্গানগর; বুড়িচংয়ের রসুলপুর ও কুমিল্লা সদরের শাসনগাছা এলাকায় বিভিন্ন লোকাল ট্রেনে করে মাদকদ্রব্য ওঠানামার দৃশ্যও অহরহ চোখে পড়ে যাত্রীদের। এ ছাড়া সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম এ দুটি উপজেলার সীমান্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ মাদক পাচার হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে।
বুড়িচংয়ের হায়দ্রাবাদনগরের বাসিন্দা মাহফুজুল আলম রুবেল বলেন, প্রতিটি এলাকায় মাদক কারবারিদের রয়েছে একাধিক গ্রুপ। প্রতিটি পয়েন্টে মাদক ও চোরাকারবারির সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ জন।
বেপরোয়া মাদক কারবারিরা
মাদক কারবারিরা এতই বেপরোয়া যে হত্যা, নির্যাতন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপরও হামলা চালায়। গত বুধবার রাতে বুড়িচংয়ের হায়দ্রাবাদনগর সীমান্ত এলাকায় মাদক কারবারিদের গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম। পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা বলছেন, চোরাকারবারি মো. রাজু সাংবাদিক মহিউদ্দিনকে কৌশলে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছেন। এরই মধ্যে গত শনিবার দিবাগত রাতে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রাজু।
এর আগে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার জোড়কানন ইউনিয়নের সুয়াগাজি এলাকার লালবাগে মাদকবিরোধী অভিযানে গেলে র্যাব সদস্যদের সঙ্গে মাদক কারবারিদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় মাদক কারবারিদের গুলিতে র্যাবের এক সদস্য গুরুতর আহত হন।
বুড়িচং উপজেলার সংকুচাইল এলাকার বাসিন্দা আবদুল হান্নান ও মনোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদক কারবারিদের কাছে এলাকার ভালো ও সচেতন মানুষ একরকম জিম্মি। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ।
এদিকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা সদর উপজেলা বিবিরবাজার সীমান্ত এলাকায় মাদক কারবারিদের হাতে অপহরণের শিকার হন নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে আসা যুবক মো. রমজান হোসেন। অপহরণকারী মাদক কারবারিরা তাঁকে চার দিন আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের ভিডিও রমজানের স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দাবি করা হয় ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ। এরই মধ্যে এ ঘটনায় তিন মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
কুমিল্লায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মধ্যে বর্তমানে মাদকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযান চালাচ্ছে র্যাব। র্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লার কম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, ‘অতীতের তুলনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা মাদক ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে বেশি তৎপর; যার কারণে মাদক উদ্ধার এবং এসব কাজে জড়িতরা বেশি গ্রেপ্তার হচ্ছে।’
২ মাসে আটক ৯ কোটি টাকার মাদক
১০ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর কুমিল্লার কোটবাড়ি প্রাঙ্গণে আগের সীমান্তে আটক করা প্রায় ৯ কোটি ২৫ লাখ এক হাজার ৯০০ টাকার মাদক ধ্বংস করা হয়। চলতি বছরের মোট মাদক জব্দের তথ্য এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি বিজিবি।
সীমান্তের মাদক কারবার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ১০ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইসহাক দৈনিক চৌকস ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সাময়িক সংস্থার প্রতিনিধিকে বলেন, ‘প্রতিদিনই বিজিবির সদস্যরা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। মূল হোতারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ বিজিবি ঘটনার তদন্ত করে না, যারা তদন্ত করে তাদের তৎপর হয়ে মূল হোতাদের কাছে পৌঁছতে হবে। মূল হোতারা আড়ালে থাকলে কিছুতেই মাদকের কারবার বন্ধ হবে না।’
সীমান্তবর্তী জেলা ফেনীর তিন উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার এলাকার প্রায় শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। মাদক সরবরাহে কাজ করছে হাজার হাজার বেকার যুবক। জড়িয়ে পড়ছে নারী, এমনকি শিশুরাও। এসব মাদক প্রথমে ফেনী সীমান্ত সংলগ্ন বাড়িতে বাড়িতে জড়ো করা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা তা ছড়িয়ে দিচ্ছে ফেনী ও পাশ্ববর্তী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।তথ্য সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ফেনীর সীমান্তকে মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ও গাজার চাহিদা বাড়ার কারণে চোরাচালানি সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভারতের ত্রিপুরা, আখাউড়া ও মিজোরাম এলাকা থেকে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকার মাদক এনে তা সুবিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দ্রুত সময়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে ফেনীসহ নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। ফেনী জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রায় শতাধিক পয়েন্ট মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে।হাত বাড়ালেই সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার অলিগলিতে মিলছে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। সহজে প্রাপ্য এসব মাদকদ্রব্যে প্রতিদিনই আসক্ত হচ্ছে নতুন নতুন যুবক। পরিবার ও সমাজে বেড়ে যাচ্ছে ঝগড়া-বিবাদসহ নানা ধরনের অপকর্মের প্রবণতা।
ফেনীর বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিনই আসছে বিপুল পরিমাণের ফেনসিডিল, মদ, গাঁজাসহ অন্যন্য মাদকদ্রব্য। এ জেলা থেকে ইজিবাইক, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ট্রেন, বাস ও ট্রাক যোগে লাকসাম, মিরসরাই, রামগড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে এসব মাদকদ্রব্য।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আর শহর-গঞ্জের চিহ্নিত শতাধিক স্পটে ভিড় জমে যায় মাদকদ্রব্য সেবনকারীদের। নির্দ্বিধায় চলে মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রয়। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর বেকার যুবক, নারীদের কাজে লাগিয়ে মাদক সিন্ডিকেট ভারত থেকে নিয়ে আসছে এসব মাদকদ্রব্য। ভারত থেকে গরুর ঔষধ পাচারকারীদের উপর প্রশাসনের নজর শিথিল থাকায় তাদের মাধ্যমে আনা হচ্ছে মাদকদ্রব্যের বড় চালান।ফেনী সীমান্ত ভারত মাদকদ্রব্য পাচারের দেশের দ্বিতীয় নিরাপদ রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে গড়ে ওঠা মাদক সিন্ডিকেট। র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য উদ্ধার করলেও ধরা পড়ছে না মাদক ব্যবসায়ীরা।ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের আমতলী এলাকার ওসমান গনি (৫০) জানান, মাদকের ভয়াল থাবায় তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ। মাদকের কারণে সমাজে খুন-খারাপিসহ নানা অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।মাদকের বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ফেনীর কঠোর অবস্থান সম্পর্কে জানালেন
মাদকের বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ফেনীর কঠোর অবস্থান সম্পর্কে জানালেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ফেনীর পরিদর্শক মো. শরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, গত এক মাসে গোপন সংবাদের ভিক্তিতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ টাকার মাদকসহ অন্তত ১৫ জন নারী-পুরুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জনবল কম থাকার কারণে কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।ফেনী র্যাব-৭ এর এএসপি জসিম উদ্দিন দৈনিক চৌকস মানবাধিকার কর্মী কে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান। বিভিন্ন সময় আমরা সফল হয়েছি।