মাথাভাঙ্গা-ভৈরব নদ, নদী সংযোগ, নদীর উপর নীতিমালা লঙ্ঘন করে সেতু নির্মাণ বন্ধ, নদী সংস্কারে দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ ও ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটি। এদাবিতে নেতৃবৃন্দ মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারক লিপি দিয়েছে।
সংগঠনের আহবায়ক অধ্যক্ষ আফসার আলী স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ভৈরব নদ হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান নদীর প্রবাহ চিত্রা-কপোতাক্ষ-বেতনা-মুক্তেশ্বরীর শাখা নদী। ব্রিটিশ আমলে দর্শনা চিনিকল ভৈরব নদের উপর নির্মাণ করায় ভৈরব নদ, মাথাভাঙ্গা ও পদ্মার নদীর পানি প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যার ফলে ভৈরবসহ এই অঞ্চলের নদী পানি ব্যবস্থাপনা প্রাণ-প্রকৃতি জীব-বৈচিত্র ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, পানি সংকটের প্রভাবে জনজীবন নানা ধরনের সংকটে পড়েছে। সুন্দরবন মিঠাপানি বঞ্চিত হয়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। জন-জীবন, কৃষি উৎপাদনেও বিপর্যয়কর পরিস্থিাতর মধ্যে পড়ে এবং স্থায়ী সংকট সৃষ্টি হয়। ষাটের দশক থেকে পোল্ডার সুইচ গেট, বাঁধ নির্মাণ ও নদী সংস্কারে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে, অর্থ অপচয় হয়েছে। এ সকল কর্মকান্ডে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। এই পরি¯ি’তি অবসানে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে ভৈরবের সংযোগ ঘটাতে পারলে যুগান্তকারী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীসমূহ প্রবাহ ফিরে পাবে, ভবদহসহ উপক‚লীয় জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। সমুদ্র থেকে উঠে আসা পলির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। নওয়াপাড়া-খুলনা নদীবন্দর ও মোংলা সমুদ্র বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবনও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি ও ঢাকার উপর বন্যার চাপ কমে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীসমূহের প্রবাহ স্বয়ংক্রীয়ভাবে সচল হবে। নদী সংস্কারে অর্থ ব্যয় সর্বনি¤œ পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে, রাষ্ট্রের অর্থের সাশ্রয় হবে। কৃষি উৎপাদনে নৌ-চলাচলে অভ‚তপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হবে।
ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে ভৈরব নদের সংযোগ প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রক্রিয়াধীন বলে আমরা অবহিত।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভৈরব নদ সংস্কারে ২৭২ কোটি ৮১ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকার গৃহিত প্রকল্প গত জুন মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। সংস্কার কাজে নদীতট আইন মানা হয়নি, যথাযথভাবে অবৈধ দখলদার উ”েছদ করা হয়নি। নদী খননের মাটি নদীগর্ভে ফেলা হয়েছে, গভীরতা নিশ্চিত না করে খননে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। নদী খালে পরিণত হয়েছে। নাব্যতা ও নৌ-চলাচলের উপযোগী করার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। সে খবর জাতীয় ও ¯’ানীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই সত্যকে আড়াল করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর শহরের দড়াটানায় নদীতটের মধ্যে পার্ক নির্মাণ করেছে। যা নদতটের অবৈধ দখলদারদের দখলদারিত্বকে যুক্তি সিদ্ধ করেছে।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, ৫২টি ব্রীজ নৌ-চলাচলের উপযোগী করে পূনঃনির্মাণ করা হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ‘এলজিইডি’ ভৈরবের উপর যশোর সদর উপজেলার দাইতলা, ছাতিয়ানতলা ও রাজারহাটে ৩টি ব্রীজ নির্মাণে ‘বিআইডবিøউটিএ’ এর আপত্তি উপেক্ষা ও সরকারি নীতিমালা লংঙ্ঘন করে নির্মাণ করছে। এমনকি ওই কাজে হাইকোর্টের জারিকৃত রুল অমান্য করে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছে।
ভৈরবের উপরে ‘এলজিইডি’ যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়ায় আরও ১টি এবং ‘সড়ক ও জনপদ বিভাগ’ যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের পাশে ব্রীজ নির্মাণ করতে যা”েছ, সেক্ষেত্রে নীতিমালা লংঙ্ঘন হ”েছ বলে আমাদের ধারনা। অনুরূপভাবে কপোতাক্ষ, চিত্রা, বেদনা, হরিহর, মুক্তেশ্বরীসহ নদীসমূহে ‘এলজিইডি’, ‘সড়ক ও জনপদ বিভাগ’ এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নীতিমালা লঙ্ঘন করে ব্রীজ-কালভার্ট তৈরি করছে। যা উজানে নদী সংযোগের পর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করবে এবং আবারও পুনঃনির্মাণের প্রশ্ন আসবে।
ভবদহ অঞ্চলের অব¯’ার আরো ভয়াবহ রূপ নিতে যা”েছ। টিআরএম প্রকল্প বাতিল করার ফলে ভবদহ ¯øুইচ গেট থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। নদীর প্রশ¯’তা এখন ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীরতা হাঁটু পানি ও মাজা পানি। বারোআউড়িয়ায় ৪ নদীর মোহনা ভরাট হয়ে গেছে। এর প্রভাব খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ উপজেলা, রূপসা, শিবসা নদী ও মোংলা বন্দরের উপর পড়বে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মোহনা পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদী অববাহিকায় ৪ শতাধিক গ্রাম ও জনপদ জলাবদ্ধতার কবলে পড়বে। এবার বোরো মৌসুমে যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা ও খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান উৎপাদন হ”েছ না, পানির তলে। দ্রæত এই পরি¯ি’তি নিরসনে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ সুপারিশ ও ২০১৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিল কপালিয়াসহ বিলে বিলে টিআরএম চালুর মাধ্যমে নদের নব্যতা রক্ষা করা জরুরি। টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ কোন ফল দেয়নি বরং বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এই সমস্যা সমাধানের সাথে এই জনপদের প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ, বসত-বাড়ি, আবাদ, ফসল রক্ষা করার প্রশ্নের সাথে জড়িত।
এমত পরি¯ি’তিতে উপরোক্ত সংকট নিরসন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী পানি ব্যব¯’াপনা, জীব-বৈচিত্র, প্রাণ-প্রকৃতি, সুন্দরবন, নওয়াপাড়া-খুলনা নদীবন্দর ও মোংলা বন্দরের প্রবাহ রক্ষায় আপনার জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি এবং নিমোক্ত দাবীসমূহ বাস্তবায়নের ৪ দাবি জানানো হয়েছে। উজানে মাথাভাঙ্গা-ভৈরব নদী সংযোগ দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে। হাইকোর্টের জারিকৃত রুল অমান্য করে ভৈরবের উপর ব্রীজ নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে হবে এবং কপোতাক্ষ, চিত্রা, বেতনা, মুক্তেশ্বরী, হরিহর সহ নদীর উপর অপরিকল্পিত সংকীর্ণ সেতু অপসারণ ও নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ভবদহ সমস্যার ¯’ায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বিল কপালিয়াসহ বিলে বিলে টিআরএম চালু করতে হবে। ভৈরব, কপোতাক্ষ সংস্কারে দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যব¯’া গ্রহণ করতে হবে।